ঢাকা , বুধবার, ২৬ মার্চ ২০২৫ , ১১ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ই-পেপার

তিন বছর ধরে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াইয়ের গল্প বললেন উপস্থাপক সামিয়া

আপলোড সময় : ২৫-০৩-২০২৫ ০২:৪৯:৩০ পূর্বাহ্ন
আপডেট সময় : ২৫-০৩-২০২৫ ০২:৪৯:৩০ পূর্বাহ্ন
তিন বছর ধরে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াইয়ের গল্প বললেন উপস্থাপক সামিয়া
প্রায় তিন বছর ধরে কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত উপস্থাপক সামিয়া আফরিন। সিঙ্গাপুরে দুই বছর চিকিৎসা নিয়েছেন। ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি এত দিন পরিবার ও কাছের বন্ধুবান্ধব ছাড়া তেমন কেউ জানতেন না। ২০ মার্চ ঢাকার বনানীতে শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের অর্থসহায়তার জন্য পোশাক প্রদর্শনীর আয়োজনে নিজের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে কথা বলেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে রোববার (২৩ মার্চ) সামিয়া গণমাধ্যমকে জানান, দুই বছর মেয়াদি চিকিৎসা কোর্স শেষ হয়েছে। সাত-আট মাস ধরে কোনো চিকিৎসা নিচ্ছেন না।

বনানীর ১২ নম্বর সড়কের ৪৪ নম্বর বাড়ির দোতলায় টেগোর টেরেসে ২০ মার্চ শুরু হয় ‘রিভোগ ওয়্যার টু কেয়ার’ নামের আয়োজন। নানা রঙের শাড়ি আর অন্যান্য বাহারি পোশাক নিয়ে তিন দিনের এই আয়োজন শেষ হয় গত শনিবার। আয়োজনের উদ্যোক্তা ও উপস্থাপক সামিয়া আফরিন জানান, ক্যানসারে আক্রান্ত মানুষদের জন্য তার এমন কিছু করার ইচ্ছা ছিল, যা সামগ্রিকভাবে সমাজের কাজে আসবে। ব্যক্তি উদ্যোগে অনেক সময় চাইলেও অনেক বড় কিছু করা সম্ভব হয় না। ভিন্নভাবে কোনো উদ্যোগ নেওয়ার ব্যাপারে আলাপ করেছিলেন বন্ধুদের সঙ্গে। সেই থেকেই শুরু। তার ভাবনায় সানন্দ সাড়া দিয়েছেন তারকা বন্ধুরা। ভবিষ্যতে ক্যানসার-বিষয়ক সচেতনতা বাড়াতে এমন আরও আয়োজনের সঙ্গে থাকার ইচ্ছা রয়েছে তার ও তার বন্ধুদের। এই আয়োজনে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার খবরটি প্রকাশ্যে আনেন সামিয়া।

সামিয়া বলেন, ‘সবাই আমাকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, কেন ক্যানসারে আক্রান্তদের জন্য পোশাক প্রদর্শনী করছি। একটা পর্যায়ে বাধ্য হয়েই আমার নিজের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার খবরটি জানাই। আমি আসলে উপলব্ধি করতে পারছিলাম যে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের কতটা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এ ধরনের রোগীদের জন্য অর্থনৈতিক বিষয়টা অনেক বড় হয়ে দেখা দেয়। অনেকেই ক্যানসারের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে পারেন না। ক্যানসারের রোগী মরেও যায়, মেরেও যায়, এ রকম একটা কথা প্রচলিত আছে। বিষয়টা হচ্ছে, আগে এই রোগ হতোই খুব কম মানুষের, তাই মানুষ মুখেও আনত না। বলতে চাইত না এই রোগের কথা। এটা একটা স্টিগমা ছিল। এখন দেখা যায়, প্রায় ঘরে ঘরে ক্যানসার। আমার এই আয়োজনের উদ্দেশ্য ক্যানসার রোগীদের অর্থসহায়তার মাধ্যমে পাশে থাকা। তাই ভাবলাম, এখন সবাই জানুক।’

সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। জীবনের এই সময়ে এসে কখনো বড় ধরনের কোনো রোগে ভোগেননি। ২০২২ সালের এপ্রিলের দিকে খুব অস্বস্তি বোধ করছিলেন। তাই ঢাকার একটি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করান। তখন জানতে পারেন যে তিনি কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত। সামিয়া বলেন, ‘২০২২ সালের এপ্রিলের দিকে আমি শারীরিকভাবে অস্বস্তি বোধ করছিলাম। তখন ঢাকার একটি হাসপাতালে পরীক্ষার পর আমাকে জানানো হলো যে শরীরে ক্যানসারের জীবাণুবাহী একটা টিউমার আছে। তখনো করোনা-পরবর্তী বিধিনিষেধ পুরোপুরি শেষ হয়নি। আমার দেবর চিকিৎসক, সে আমাকে বিস্তারিত কিছু না বলে শুধু এটুকু বলল, ‌‘তোমার রিপোর্ট একটু খারাপ। তুমি যদি চাও দেশের বাইরে দেখাতে, তাহলে এখনই ব্যবস্থা নাও।’ এ কথা শোনার পর তিন-চার দিনের মধ্যে খোঁজ-খবর নিতে শুরু করলাম। একটা সময় শুনলাম, সিঙ্গাপুরে যাওয়া যাবে। আমি আর আমার স্বামী চলে গেলাম। আমি যখন ব্যাগ গোছাই, তখনো জানি না, কত দিন থাকতে হবে। কত দিনের প্রস্তুতি নিয়ে যাব। কত টাকা সঙ্গে নিয়ে যাব, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এ সময় দেখলাম, সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছিল আমার স্বামী। ওর চেহারার দিকে তাকানো যেত না। আমিই উল্টো তাকে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছি, কোথায় সে আমাকে দেবে!’

২০২২ সালের এপ্রিলেই স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে উড়াল দিলেন সামিয়া আফরিন। তার মতে, দেশের রিপোর্টে কোথাও হয়তো ভুল হচ্ছে। তার শরীরের কোলন ক্যানসার, এটা তিনি কোনোভাবেই মানতে পারছিলেন না। বিষয়টি উল্লেখ করে সামিয়া বলেন, ‘প্রথমে দুই সপ্তাহের জন্য সিঙ্গাপুরে যাই। কেন জানি বারবার এটা মনে হচ্ছিল যে কোথাও যেন কিছু একটা ভুল হচ্ছে। আমি এত স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করি। খাওয়াদাওয়া সবকিছু ঠিকঠাক করি, জিম করি। আমার তো এমনটা হওয়ার কথা নয়। হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে। তারপর যা-ই হোক, ওখানে সব পরীক্ষা করলাম।

এরপর সিঙ্গাপুর থেকে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাকে জানাল, এটা শুধু ক্যানসার নয়, এটা ক্যানসারের চতুর্থ ধাপ! ক্যানসারের ক্ষতিকর জীবাণু এরই মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে ফুসফুসে, লিম্ফ নোডসে। দুইটা হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাপদ্ধতি শোনানো হলো। বলা হলো, আমার টিউমার ফেলে দিতে হবে। আমাকে একটা ব্যাগ বহন করতে হবে। ব্যাগ বহন করার কথা শুনে ভেঙে পড়েছিলাম। আমি ভাবতেই পারিনি যে আমার জীবনধারা বদলে যাবে! তখন হুট করে ভাবলাম, আমি কোনো চিকিৎসাই করাব না। অনড় ছিলাম। ভাগ্যে যা আছে, তা-ই হবে। এটা ভাবছিলাম, মানুষ তো পৃথিবীতে আসে, থাকে, একসময় মারা যায়, এটাই সত্য। তো আমারও যা হওয়ার, হবে। এ ধরনের কঠিন কোনো জীবনযাপন মেনে নেব না, যেটার জন্য আমার এত ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হবে।’

সামিয়া জানালেন, দুই হাসপাতালের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সিঙ্গাপুরের সরকারি হাসপাতালে আরেকটা পরীক্ষা করান। সেখানে ক্যানসার চিকিৎসার নতুন পদ্ধতির কথা জানান চিকিৎসকেরা।

সামিয়া বলেন, ‘সরকারি হাসপাতালে যাওয়ার পর সেখানকার চিকিৎসকেরা বলেন, ‘আপনার সঙ্গে অন্য পদ্ধতিতে চিকিৎসায় যাব।’ ওই চিকিৎসকেরা আমাকে জানালেন যে তারা আমাকে ইমিউনো থেরাপি দেবেন। কারণ, ক্যানসার রোগীদের কেমোথেরাপি দিলে অনেক দুর্বল হয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু ইমিউনো থেরাপি শরীরে ক্যানসার প্রতিরোধক কোষ তৈরি করতে থাকে। অন্য কোষগুলো এই পদ্ধতিতে মরে না। তবে এটা প্রচণ্ড ব্যয়বহুল। এই চিকিৎসাপদ্ধতির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয় ২০১৯-২০ সালের দিকে। আবার সব জায়গায় তা পাওয়াও যায় না। তারা বলছিলেন যে চেষ্টা করবে। শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থা হলো। ২১ দিন পরপর আমাকে ডোজ দিতে হবে। আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম, নেব। শুরুতে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। প্রথম চার-পাঁচ মাস তো আমার শরীর ভীষণ খারাপ হতে থাকে। অনেক দুর্বল হয়ে পড়ি। ওষুধ নেওয়ার পর হেঁটে ১০ কদম যাওয়ার শক্তিও পেতাম না। শরীর কাঁপত। চামড়ায় সমস্যা হতো। ওষুধ নিতাম। শুরুতে স্বামী সঙ্গে থাকত। পরে আমি না করে দেই। একা একাই যাই। কেউ আমাকে দেখলে বোঝারও উপায় ছিল না যে আমি অসুস্থ। এমনকি এমনও হয়েছে যে ডোজ দিয়ে আসছি, বাসায় দাওয়াত চলছে। তানিয়া (তানিয়া হোসাইন), বাপ্পাদারা (বাপ্পা মজুমদার) আড্ডা দিচ্ছেন। আমি ৩০ মিনিট বিশ্রাম নিয়ে সেই আড্ডায় যোগ দিয়েছি। আবার গল্প করেছি। ওগুলো তো বন্ধ করা যাবে না। সবকিছু চালাতে হবে।’

কোলন ক্যানসারে আক্রান্ত সামিয়া আফরিনের চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু তা তিনি কাউকে বুঝতে দিতে চাননি। সামিয়ার মতে, ‘মানসিকভাবে ভাবতে চাইনি যে আমি অসুস্থ। অসুস্থতার কারণে আমি এই কাজ করতে পারব না, সেই কাজ করতে পারব না, এটা ভাবতে চাইনি। আমি এই অসুস্থতার মধ্যেও তাই অফিস করেছি। এমনও হয়েছে, কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি, এরপর বিশ্রাম করতাম, আবার উঠে কাজ করতাম। এ সময় সবচেয়ে বেশি শারীরিক দুর্বলতা কাজ করে। কাজ করার ইচ্ছা থাকে না। শরীর টানে না। ত্বকে র‍্যাশ হতে থাকে। অনেক কিছুই হয়, খারাপ-ভালো মিলিয়ে। অসুস্থতা নিয়ে কথা বলতে গেলে মানুষের অনেক সহানুভূতির কথা শুনতে হয়। আমি সহানুভূতি নিতে চাইনি। আমার মা-বাবা ছাড়া আত্মীয়স্বজনদেরও বলিনি। আর বলেছি ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের।’

উপস্থাপক সামিয়া আফরিনের একটা বন্ধুমহল আছে। সেই বন্ধুমহলে আছেন মুস্তফা খালিদ পলাশ, পার্থ বড়ুয়া, বাপ্পা মজুমদার, রাশিদ খান, তানিয়া হোসাইন, চৈতী, তানভীর খান প্রমুখ। ক্যানসারের সময় বন্ধুরা সর্বক্ষণ তার পাশে ছিলেন। নানাভাবে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। এরই মধ্যে সামিয়ার দুই বছরের কোর্স শেষ হয়েছে। তিনি জানান, দুই বছরের কোর্স শেষ করার পর পরিস্থিতি এখন স্থিতিশীল। ক্যানসারের জীবাণু শরীরে আর ছড়ায়নি। চিকিৎসকেরা আশাবাদী যে এই অবস্থাই হয়তো থাকবে।

সামিয়া বলেন, ‘কাছের বন্ধুবান্ধবেরা আমাকে সার্বক্ষণিক মানসিক শক্তি ও সাহস জুগিয়েছে। ওরা সব সময় খোঁজখবর নিয়েছে। প্রথম দিন তানিয়া শোনার পর যেভাবে কান্নাকাটি করেছে, আমি নিজেই ঘাবড়ে গেছি। কাছের বন্ধুরা সবাই আমাকে সুন্দর অনুভূতি দিয়েছে। আমাকে অনুভবই করতে দেয়নি, কী হয়েছে আমার। কিছুদিন পরপরই কেউ না কেউ বলত, ‘চলো আমরা এটা করি, সেটা করি। আড্ডা দিই।’ সবকিছুই আমাকে কেন্দ্র করেই ওরা করত। আমি কখন আছি, না আছি জেনেই আয়োজন করত।’

সামিয়া জানান, ক্যানসারের চতুর্থ ধাপ মানে একদম শেষ পর্যায়। এরপর বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে দ্রুত জীবাণু ছড়িয়ে পড়তে থাকে। নষ্ট হতে থাকে শরীরের অনেক কিছু। কর্মক্ষমতা কমে যায়।

সামিয়া বলেন, ‘অলৌকিক হোক বা ওষুধের মাধ্যমে হোক, ক্যানসারের জীবাণুটা আর ছড়াচ্ছে না। যা আছে, তা-ও সুপ্ত অবস্থায় আছে। তবে আল্লাহ কখন কী ঘটান, কিছুই জানি না। এটা নিয়ে তাই বলারও কিছু নেই। এটা ভেবে স্বস্তি লাগছে যে সাত-আট মাস ধরে কোনো ওষুধ খাচ্ছি না এবং কেমোও নিচ্ছি না। এখন কিছু স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারি। চাপও নিতে পারি, যা দুই বছর আগে একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছিলাম। অনেক অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলতাম। রাত ১০-১১টার পর আমার ক্লান্ত লাগত। ঘুম পেত। ভালো লাগত না। এখন আবার সবকিছু স্বাভাবিক হচ্ছে।’

নিউজটি আপডেট করেছেন : mainadmin

কমেন্ট বক্স

প্রতিবেদকের তথ্য

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ